বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতি সাধনে মিশরীয় ও সিন্ধুসভ্যতার অবদান সংক্রান্ত তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করে উভয় সভ্যতার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর একটি প্রতিবেদন তৈরি কর।
বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতি সাধনে মিশরীয় ও সিন্ধুসভ্যতার অবদান সংক্রান্ত তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করে উভয় সভ্যতার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর একটি প্রতিবেদন তৈরি কর।
বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতি সাধনে মিশরীয় সভ্যতার অবদান
আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর পূর্ব অংশে বর্তমানে যে দেশটির নাম ইজিপ্ট, সেই দেশেরই প্রাচীন নাম মিশর। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৩২০০ অব্দ পর্যন্ত নীল নদের অববাহিকায় একটি সমৃদ্ধ জনপদেও উদ্ভব হয়, যা প্রাচীন মিশর সভ্যতায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
তিনটি মহাদেশ দ্বারা ঘিরে থাকা মিশরের ভৌগলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশটি এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরােপ মহাদেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অবস্থিত।
এর উত্তরে ভূমধ্যসাগর, পূর্বে লােহিত সাগর, পশ্চিমে । সাহারা মরুভূমি, দক্ষিনে সুদান ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশ।
সভ্যতায় মিশরীয়দের অবদান: প্রাচীন সভ্যতায় মিশরীয়দের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। ধর্মায়। চিন্তা, শিল্প, ভাস্কর্য, লিখন পদ্ধতি, কাগজের আবিষ্কার, জ্ঞান বিজ্ঞানচর্চা—সবকিছুই তাদের অবদানে সমৃদ্ধ। মিশরীয়দের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, তাদের জীবন ধর্মীয় চিন্তা ও বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
সভ্যতায় মিশরীয়দের অবদানের কয়েকটি উল্লেখযােগ্য বিষয়
শিল্প: মিশরীয়দের চিত্রকলা বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরত্বপূর্ণ। অন্যান্য দেশের মতাে চিত্রশিল্পও গড়ে উঠেছিল ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে। তারা সমাধি আর মন্দিরের দেয়াল সাজাতে গিয়ে চিত্রশিল্পের সূচনা করে। তাদের প্রিয় রং ছিল সাদা-কালাে । সমাধি, পিরামিড, মন্দির, প্রাসাদ, প্রমােদ কানন, সাধারণ ঘর-বাড়ির দেয়ালে মিশরীয় চিত্রশিল্পীরা অসাধারণ ছবি এঁকেছেন। সেসব ছবির মধ্যে সমসাময়িক মিশরের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের কাহিনি ফুটে উঠেছে।
লিখনপদ্ধতি ও কাগজ আবিষ্কার: মিশরীয় সভ্যতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল লিপি বা অক্ষর আবিষ্কার। নগর সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মিশরীয় লিখনপদ্ধতির উদ্ভব ঘটে। পাঁচ হাজার বছর পূর্বে তারা সর্বপ্রথম ২৪টি ব্যঞ্জনবর্ণের বর্ণমালা আবিষ্কার করে। প্রথম দিকে ছবি এঁকে তারা মনের ভাব প্রকাশ করত। এই লিখন পদ্ধতির নাম ছিল হায়ারোগ্লিফিক।
ভাস্কর্য: ভাস্কর্য শিল্পে মিশরীয়দের মতাে প্রতিভার ছাপ আর কেউ রাখতে সক্ষম হয়নি। ব্যাপকতা, বৈচিত্র্য এবং ধর্মীয় ভাবধারায় প্রভাবিত বিশাল আকারের পাথরের মূর্তিগুলাে ভাস্কর্য শিল্পে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। প্রতিটি ভাস্কর্য ধর্মীয় ভাবধারা, আচার অনুষ্ঠান, মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। প্রতিটি শিল্পই ছিল আসলে ধর্মীয় শিল্পকলা। সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য হচ্ছে গিজার অতুলনীয় কিংস। ফিংকস হচ্ছে এমন একটি মূর্তি, যার দেহ সিংহের মতাে, কিন্তু মুখ মানুষের মতাে। মিশরের সবচেয়ে বড় পিরামিড হচ্ছে ফারাও খুফুর পিরামিড। মন্দিরগুলােতে মিশরীয় ভাস্কর্য স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন প্রতিফলিত হয় ।
মিশরীয়দের আর্থ-সামাজিক অবস্থা
পেশার ওপর ভিত্তি করে মিশরীয়দের কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন- রাজপরিবার, পুরােহিত, অভিজাত, লিপিকার, ব্যবসায়ী, শিল্পী এবং কৃষক ও ভূমিদাস শ্রেণি । মিশরের অর্থনীতি মূলত ছিল কৃষিনির্ভর। উৎপাদিত ফসলের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল গম, যব, তুলা, পেঁয়াজ, পিচফল ইত্যাদি। ব্যবসা-বাণিজ্যেও মিশর ছিল অগ্রগামী। মিশরে উৎপাদিত গম, লিনেন কাপড় ও মাটির পাত্র ক্রিট দ্বীপ, ফিনিশিয়া, ফিলিস্তিন ও সিরিয়ায় রপ্তানি হতাে। বিভিন্ন দেশ থেকে মিশরীয়রা স্বর্ণ, রৌপ্য, হাতির দাঁত, কাঠ ইত্যাদি আমদানি করত।
মিশরীয়দের অর্থনীতিতে নীলনদের অবদান: নীল নদ মিশরের নীল নদের উৎপত্তি আফ্রিকার লেক ভিক্টোরিয়া থেকে। সেখান থেকে নদটি নানা দেশ হয়ে মিশরের মধ্য দিয়ে ভূ-মধ্যসাগরে এসে পড়েছে। ইতিহাসের জনক হেরােডােটাস যথার্থই বলেছেন- “মিশর নীল নদের দান’। নীল নদ না থাকলে মিশর মরুভূমিতে পরিণত হতাে। প্রাচীনকালে প্রতিবছর নীল নদে বন্যা হতাে। বন্যার পর পানি সরে গেলে দুই তীরে পলিমাটি পড়ে জমি উর্বর হতাে। জমে থাকা পলিমাটিতে জন্মাতাে নানা ধরনের ফসল।
বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতি সাধনে সিন্ধু সভ্যতার অবদান
সিন্ধু নদের অববাহিকায় গড়ে উঠেছিল বলে এর নাম রাখা হয় সিন্ধু সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতার সংস্কৃতিকে হরপ্পা সংস্কৃতি বা হরপ্পা সভ্যতা ও বলা হয় । ঐতিহাসিকদের মতে ২৫০০ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এ সভ্যতা টিকে ছিল। ঐতিহাসিকরা আরাে মনে করেন পাঞ্জাব থেকে আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভৌগলিক এলাকা জুড়ে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠে ছিল। পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলাের অন্যতম হল সিন্ধু সভ্যতা তাই বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতিতে তার অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার অবদানের কয়েকটি দিক হল।
নগর পরিকল্পনা: সিন্ধুসভ্যতার এলাকায় যেসব শহর আবিস্কৃত হয়েছে তার মধ্যে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারাে সবচেয়ে বড় শহর। ঘরবাড়ি সবই পােড়ামাটি বা রােদে পােড়ানাে ইট দিয়ে তৈরি। শহরগুলাের বাড়িঘরের নকশা থেকে সহজেই বােঝা যায় যে, সিন্ধুসভ্যতা যুগের অধিবাসীরা উন্নত নগরকেন্দ্রিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারাের নগর পরিকল্পনা একই রকম ছিল। নগরীর ভেতর দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। রাস্তাগুলাে ছিল সােজা। প্রত্যেকটি বাড়িতে খােলা জায়গা, কৃপ ও স্নানাগার ছিল। জল নিষ্কাশনের জন্যে ছােট নর্দমাগুলােকে মূল নর্দমার সাথে সংযুক্ত করা হতাে। রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হতাে। পথের ধারে ছিল সারিবদ্ধ ল্যাম্পপােস্ট।
পরিমাপ পদ্ধতি: সিন্ধুসভ্যতা যুগের অধিবাসীরা দ্রব্যের ওজন পরিমাপ করতে শিখেছিল। তাদের এই পরিমাপ পদ্ধতির আবিষ্কার সভ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান বলে বিবেচিত। তারা বিভিন্ন দ্রব্য ওজনের জন্য নানা মাপের ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির বাটখারা ব্যবহার করত। দাগ কাটা স্কেল দিয়ে দৈর্ঘ্য মাপার পদ্ধতিও তাদের জানা ছিল।
স্থাপত্য ও ভাস্কর্য: সিন্ধুসভ্যতা যুগের অধিবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ এবং চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন রেখে গেছে। সেখানে দুই কক্ষ থেকে পঁচিশ কক্ষের বাড়ির সন্ধানও পাওয়া গেছে।
সিন্ধু সভ্যতার আর্থ-সামাজিক অবস্থা
সিন্ধু সভতার অর্থনীতি ছিল মূলত কৃষি নির্ভর। তাছাড়া অর্থনীতির একটি বড় দিক ছিল পশুপালন। কৃষি ও পশুপালনের পাশাপাশি মৃৎপাত্র নির্মাণ, ধাতুশিল্প, বয়নশিল্প, অলঙ্কার নির্মাণ, পাথরের কাজ ইত্যাদিতেও তারা যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছিল। এই উন্নতমানের শিল্পপণ্য বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে সেখানকার বণিকরা বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যােগাযােগ রক্ষা করে চলত। বণিকদের সাথে আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান, মধ্য এশিয়া, পারস্য, মেসােপটেমিয়া, দক্ষিণ ভারত, রাজপুতনা, গুজরাট প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যােগাযােগ ছিল।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি, আজ আমরা যে আধুনিক বিশ্ব দেখি তা একদিনে নির্মিত হয়নি। আমাদের পূর্বে বহু জাতি বহু সভ্যতা তিল তিল করে এই মানব সভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছে । তার ধারাবাহিকতায় আজ আমরা পেয়েছি আধুনিক বিশ্ব। তাই বিশ্বসভ্যতায় প্রাচীন সভ্যতার গুরুত্ব অপরিসীম।